বাংলাদেশ ০১:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“কেন আমি শিবির ছাড়লাম?” শিরোনামে লেখক আসিফ মাহমুদের বেদনাদায়ক স্মৃতিচারণ

তরুণ লেখক আসিফ মাহমুদ সম্প্রতি তার ফেসবুক পোস্টে এক বেদনাদায়ক স্মৃতিচারণ করেছেন, যেখানে তিনি কেন ছাত্রশিবির ত্যাগ করেছেন তা বর্ণনা করেছেন। কৈশোরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাগুলোর কথা তিনি তুলে ধরেছেন, যা তাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

​আসিফ তার লেখায় জানান, তিনি স্কুলজীবনে কীভাবে  ইসলামিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বন্ধুদের প্রভাবে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত হন। একজন নিয়মিত ছাত্র থেকে তিনি সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন। তার কথায়, এ সময় তিনি সাংগঠনিক নিয়মকানুন মেনে চলা এবং ধর্মীয় পড়াশোনায় মনোযোগী হন, যা তার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ছাত্রশিবির নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন স্মৃতিচারণমূলক একটি পোস্ট দেন আসিফ মাহমুদ। যেখানে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।

তার পোস্ট করা ফেসবুকের লেখাটি হল-

“কেন আমি শিবির ছাড়লাম?

(১)

২০১২ সালের শেষের দিকের কথা। ক্লাস নাইন শেষ হবে হবে করছে। আমি তখন তুমুল কবি। ঝড়ো কবিতা লিখি। সেই কবিতাগুলো একটা ডায়েরি, দিস্তা কাগজের পাতা, নোটপ্যাডের পাতা – এসব জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ছিলো। আমি সবগুলোকে একত্র করে একটা ফাইলে রাখতাম। ফাইলটা হারিয়ে ফেলেছি, ভেবে খুব মন খারাপ হয়।  লিখতাম ইসলামী কবিতা, প্রতিবাদী কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা। গদ্যছন্দ বুঝতাম না। তবুও গদ্যছন্দে কিছু কবিতা লেখার বৃথা চেষ্টাও করেছিলাম। একটা প্যাটার্ন কমন ছিলো। কবিতাগুলোয় ‘বিপ্লবী’ ধাঁচ ছিলো। নবম শ্রেণীর একজন ছাত্রের কাছে ‘বিপ্লব’ যতখানি আরকি। এরকম লেখালিখির কারণ ছিলো আমি ধার্মিক পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা, সেখানে ইসলামের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর পাশাপাশি ‘পলিটিকাল ইসলাম’ এর আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিলো। এভাবে বেড়ে ওঠার কারণেই হয়ত আমি ঐ ধাঁচের লেখা লিখতাম, ঐ ধাঁচের চিন্তা করতাম। তো, ‘১২ সালের শেষদিকে এসে আমি আমার বন্ধু মোকারমের সাথে প্রায়ই আমার চিন্তা শেয়ার করতাম। সেইসময় দেশের রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ট্রায়াল চলছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে’। সারাদেশে চলছে ‘জামায়াত-শিবির’ বিরোধী তুমুল ক্যাম্পেইন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলো শাহবাগ। সেই টালমাটাল সময়ে আমার আর মোকারমের আড্ডা হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দেশের রাজনীতি নিয়ে, ইসলাম নিয়ে। মোকারম ছিলো শিবিরের সাথী। ও যখনই আমাকে শিবিরে যোগ দিতে বলতো, আমি একের পর এক প্রশ্ন করতাম। ‘নারী নেতৃত্ব’, ‘গণতন্ত্র’, ‘দাঁড়ি ছোট রাখা’ –এসব ব্যাপার নিয়ে তর্ক করতাম। মোকারম সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো না। কারণ, বলাই বাহুল্য, সেও আমার মত নবম শ্রেণীতেই পড়ে।

(২)

কিন্তু, ওর সাথে আলাপচারিতার সময়েই আমার একটা পর্যায়ে মনে হয় আমার শিবিরে যাওয়া উচিত। এরপর, যা ভাবা তাই কাজ। প্রথমে সমর্থক, তারপর কর্মী হয়ে গেলাম। কর্মী হওয়ার পর একটা বড় রিপোর্ট বই ধরিয়ে দিলো। বিপাকে পড়লাম। নামাজের হিসাব, কুরআন পড়ার হিসাব, হাদীস পড়ার হিসাব, বই পড়ার হিসাব। হিমশিম খেতাম। সাথী হওয়ার শর্ত ছিলো টানা তিন মাস কোনো নামাজ মিস করা যাবে না। আমি টানা কয়েকটা তিন মাসের সাইকেল আপ্রাণ চেষ্টা করেও ঠিক রাখতে পারিনি। দুয়েকটা ফজর মিস হয়েই যেত। বইগুলো পড়তাম। কুরআন শুদ্ধ করে পড়া শিখলাম। বেশ অনেকগুলো আয়াত মুখস্ত করলাম সিলেবাসের কল্যাণে। হাদীসও মুখস্ত হয়ে গেল অনেকগুলো। শিবিরের কল্যাণেই এত নিয়মিত বেসিসে আমি কুরআন-হাদীস পড়েছি সেসময়, তাগাদা নিয়ে কুরআন শুদ্ধ করেছি –এসব মনে পড়লে ওদের জন্য দোয়া আসে। দিন গড়ায়, দশম শ্রেণীতে উঠি। চলে আসে উত্তাল ’১৩ সাল। শিবিরের সেটাপ হয়। আমাকে স্কুল শাখার ‘ছাত্র কল্যাণ সম্পাদক’ বানিয়ে দেয়া হয়। আমি নাকি দায়িত্বশীল! আমি নামাজ মিস করি। গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না। পারিনা কারো সাথে গিয়ে নিজে থেকে মিশতে, বন্ধুত্ব পাতাতে। সেখানে ‘দাওয়াতি’ কাজ তো বহু দূর কি বাত! তার ওপর আমি রেবেল। প্রোগ্রামে গিয়ে জেলা থেকে আসা, মহানগর থেকে আসা শিবিরের দায়িত্বশীলদের কড়া কড়া প্রশ্ন করি। তারা বোধহয় ভাবেন, এই পিচ্চি ছেলে এসব কী বলে! নূরনবী ভাই মুচকি মুচকি হাসেন। নূরনবী ভাই তখন থানা সভাপতি। আমি আজ পর্যন্ত উনার মত আন্তরিক আর ভদ্র মানুষ আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হাসিমুখে কথা বলেন, দেখা হলেই জড়িয়ে ধরেন। পড়াশোনা করতে বলেন। শিবির ছেড়ে আসার পরও সবসময় অমায়িক ব্যবহারই পেয়েছি তার কাছে। তো এসবের পরও আমি যখন ‘দায়িত্বশীল’ হয়ে গেলাম, তখন মনে হলো – কিছু দায়িত্ব নিতে হবে এবার। আমি আর মোকারম মিলে ইন্ডিভিজুয়ালি ক্লাসের অনেকের সাথে ওয়ান টু ওয়ান বসতাম। দিনের পর দিন সময় দিতাম। সেটার রেজাল্ট দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই। আমাদের ক্লাসেই প্রায় ২০ জনের অধিক কর্মী হয়ে যায় মাত্র কয়েক মাসে। যারা হয় না, তারাও প্রোগ্রামে যায়, বই পড়ে, একসাথে নামাজে যায়। আতাতুর্ক স্কুলের ১৪তম ব্যাচের নামই পড়ে গিয়েছিলো ‘শিবির ব্যাচ’। গল্পের মত না? কিন্তু এর পরপরই শুরু হয় ভয়ঙ্কর দিনগুলো।

(৩)

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় দেয়ার পর ঢাকায় বসে যায় গণজাগরণ মঞ্চ। সেই ভয়ঙ্কর শাহবাগ, তখনো জানতাম না – এটা জন্ম দিতে যাচ্ছে এক অনিঃশেষ ফ্যাসিবাদের। শাহবাগে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সারা বাংলাদেশে একটা ‘জামায়াত-শিবির বিরোধী’ ওয়েভ শুরু হয়। এর আগে কার্যত আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগের তৃণমূলে তেমন আধিপত্য ছিলো না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ফাংশন করছিলো এজ ইউজুয়াল। কিন্তু, শাহবাগ শুরু হওয়ার পর জামায়াত এবং শিবিরকে ক্রমাগত ডিমনাইজ এবং ডিহিউম্যানাইজ করা শুরু হয়। ‘বুদ্ধিজীবীরা’ বয়ান উৎপাদন করতে শুরু করেন, শাহবাগ ‘মব ভয়েস’ এর মাধ্যমে সেই বয়ান ছড়ায়, মিডিয়াগুলো সেটাকে এমপ্লিফাই করে। আর এরপরই সরকার শুরু করে দমন-পীড়ন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় ক্র‍্যাকডাউন। আমাদের স্কুলও ব্যতিক্রম ছিলো না। চেয়ারম্যান সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। তার দরকার ছিলো একটা লিস্ট। সেই লিস্টটা পেয়ে যায় আমাদেরই একজন ব্যাচমেট থেকে। আমাদের ক্লাসে গুণেগুণে দুইজন ‘শাহবাগী’ ছিলো। একজন বংশগতভাবে আওয়ামীলীগ, রিজিড এবং ভায়োলেন্ট। অন্যজন কিছুটা লেস রিজিড, কিন্তু লীগ। এই দুইজনের সাথে শাহবাগের সময়ে আমাদের ভীষণ তর্ক হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলের করিডোরে, খেলার মাঠে, নাস্তার টেবিলে। সবখানে। শাহবাগের সাজানো রায় নিয়ে তর্ক, শাহবাগিদের ব্লাসফেমি নিয়ে তর্ক, পরবর্তীতে হেফাজতে ইসলামের উপর গণহত্যার সময়কালীন ঘটনা নিয়ে তর্ক। তর্ক চলতেই থাকতো। কিন্তু, কখনো সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে যায়নি। বন্ধু হিসেবেই দেখতাম। আমরা তার কোনো ক্ষতি কখনো করবো না এটা ডেটারমাইন্ড ছিলাম, আর সে যে কখনো আমাদের ক্ষতি করবে না –এমন আত্মবিশ্বাসই ছিলো। কিন্ত, আল্টিমেটলি সে স্কুলে কারা শিবিরকে লিড দিচ্ছে, তাদের একটা লিস্ট চেয়ারম্যানের কাছে তুলে দেয়। এরপর শুরু পালিয়ে বেড়ানোর দিন..

(৪)

আমাদের শিক্ষকরা আমাদের ব্যাপারে খুব সাপোর্টিভ ছিলেন। অনেকেই জানতেন আমরা কারা শিবির করি। নামাজ পড়তাম, ভালো আচরণ করতাম, ক্লাসেও টপার ছিলাম – তাই পছন্দ করতেন। একদিন, সবে প্রথম পিরিয়ড শেষ হলো। ক্লাসে বসে আছি। একজন স্যার আমাকে ক্লাসের বাইরে থেকে ডাকলেন। আমি গেলাম, সালাম দিলাম। স্যারকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছিলো। স্যার বললেন, “তোমাদের যারা আছে, সবাইকে নিয়ে সরে যাও, আজকে আর স্কুলে থাকার দরকার নাই। বাসায় চলে যাও। আজকে রেইড হবে। চেয়ারম্যান আসবে, পুলিশ আসবে।” ভাবতে পারেন? আমরা সবে ক্লাস টেনে পড়ি। আমাদের মত বাচ্চা ছেলেদের ধরতে স্কুলে পুলিশ আসবে, চেয়ারম্যান আসবে। একে একে সবাইকে নিয়ে সেদিন সরে পড়ি। কিন্তু, এরপর থেকে প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছিলো এই ঘটনা। আমার মনে পড়ে না ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষ অবধি কখনো শান্তিতে ক্লাস করতে পেরেছি কীনা। একেকদিন ফিফথ পিরিয়ডে, থার্ড পিরিয়ডে ব্যাগ বই গুছিয়ে পালাতে হয়েছে। আর বাকি দিনগুলোতে ছিলো ছাত্রলীগ আতঙ্ক। ইনফরমেশন পেতাম, ছাত্রলীগ স্কুল গেইটে অবস্থান নিয়েছে। দেখতে পেলেই মারবে। কোনোদিন দেয়াল টপকে বের হতাম। কোনোদিন ভিড়ের মধ্যে মিশে বের হতাম। আমরা ছিলাম ক্লাসের টপার, স্কুলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছাত্র, শিক্ষকদের আদরের পাত্র। তারপরও কেবল শিবির করার ‘অপরাধে’ আমরা হয়ে গিয়েছিলাম ঊনমানুষ। আমরা সাপোর্টিভ শিক্ষক পেয়েছিলাম বলে টিকে গেছিলাম, নাহলে অসংখ্যবার আমাদেরকে হাসপাতালে যেতে হত, খাটতে হতো জেল। আমি তখন বারবার ভাবতাম, কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? আমি তো কাউকে মারছি না। কারো ক্ষতি করছি না। একটা সংগঠনের রাজনীতি ভালো লাগে আমার, তাই সেই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি। এটা কি অপরাধ? কেন আমাকে মারবে? কেন জেলে দেবে? আমরা কি আদৌ স্বাধীন?

(৫)

২০১৩ সাল আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তাল সময়। বিশেষত, সাঈদী সাহেবের রায়ের দিনের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। সারাদিনে জামায়াত এবং শিবিরের প্রায় ৭০-৮০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ লীগ আর আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা গুলি করে মেরে ফেলে। সারাদিন মৃত্যুর সংবাদ শুনি, কান্না করি। চট্টগ্রামে কোমরের কাছে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার ভিডিও দেখে মন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। আব্বু-আম্মুর কড়া নিষেধাজ্ঞায় সেদিন মিছিলে যেতে পারিনা। কিন্তু, সেদিনের সেই ভয়াবহ গণহত্যা দেখার পর সিদ্ধান্ত নেই, আর আব্বু-আম্মুর নিষেধের তোয়াক্কা করবো না। তড়িৎ সিদ্ধান্ত। তখনো জানিনা, এই সিদ্ধান্ত কোনো একদিন আমার জীবনে একটা অন্ধকার দিন নামিয়ে আনবে।

সাঈদীর সাহেবের রায়ের পর থেকে প্রতিটি বিক্ষোভ মিছিলে যেতাম। গলার রগ ফুলিয়ে ‘তাকবীর’ দিতাম। রোদের ঝাঁঝে গা জ্বলতো, ঘাম আর কান্না মিশে যেতো। অদূরে পুলিশ বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে থাকতো। মৃত্যু দেখতাম চোখের সামনে। কখনো সেই মৃত্যু আমাদের ধাওয়া দিতো। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতাম। যেই সাহস আর শক্তি নিয়ে আম্মুর নিষেধকে অমান্য করে আসতাম, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই সাহস আর শক্তি থাকতো না। ভয় পেতাম, পা কুঁকড়ে আসতো। দূর থেকে শুনতে পেতাম আবছা আবছা গান, যা শুনে একসময় আন্দোলিত হয়েছি,

“সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে, আমাকেও রাখিও রহমান,
যারা কোরআনের আহ্বানে নির্ভিক, নির্ভয়ে সব করে দান”

সেই গান ক্রমাগত দূরে সরে যেত। গানের জায়গায় বাজতো বুকের ধুকপুক শব্দ। সাহসের স্থানে সেখানে জায়গা করে নিয়েছিলো ভয়। কিন্তু, কফিনে শেষ পেরেক তখনো বাকি ছিলো।

(৬)

২০১৫ সালের কোনো এক বিকেল। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সবে, অথবা সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুরা মাঠে ক্রিকেট খেলছি। মোকারমকে সাথে করে আমাদের স্কুল সভাপতি এলেন। এসে বললেন, আসরের পর আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার মাঠে শহীদ কামারুজ্জামানের গায়েবানা জানাযা হবে, আমরা যারা চাই, তারা যেন যাই। আসরের আজান হওয়ার পর আমরা মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে যাই। ওজু করে বসে থাকি নামাজের অপেক্ষায়। মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে অনেক মানুষ। আলেম ওলামা, শিবিরের ছেলেরা, জামায়াতের লোকেরা, সাধারণ মুসল্লিসহ অনেকে। মাদ্রাসা গমগম করছে। মাদ্রাসার সাথে লাগোয়া মসজিদ, চারপাশে ঘেরা। বের হওয়ার রাস্তা একটা, আর ওজুখানার পাশে ডোবা। আমাদের কল্পনায়ও ছিলো না এক ভয়ঙ্কর আজাব সেদিন নেমে আসবে। বারান্দায় জায়গা পেলাম, সেখানেই দাঁড়িয়েছি নামাজে। দুই রাকাত শেষ হওয়ার পরই অনেক লোকের গলার আওয়াজ, অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনতে পাই। তখনও ঘটনার ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারিনি। শেষ বৈঠকে বসেছি। ডানদিকে সালাম ফেরালাম, সবার আগে চোখে পড়লো একটা প্রকাণ্ড রাইফেল। সালাম ফিরিয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য। আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যানের হাতে হ্যান্ডগান। ছাত্রলীগের কয়েকজন সন্ত্রাসীর হাতে বড় বন্দুক। আর মেইনগেইট ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধশত সন্ত্রাসী। সবার হাতে দেশী অস্ত্র, রড, পাশের সমেইল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠ। মূহুর্তের মধ্যে আমার জগৎ এলোমেলো হয়ে গেল। চেয়ারম্যান সাহেব বন্দুক উঁচিয়ে দুইটা ফায়ার করলেন, অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললেন “সবাইকে ধরতে”। শুরু হয়ে গেলো ছোটাছুটি। সবাই ছিটকে মাদ্রাসা আর মসজিদের ভেতর ঢুকতে লাগলো। আর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ঝাপিয়ে পড়লো। আমরা চিহ্নিত শিবির। ধরা পড়লে বাঁচার উপায় নেই। ওজুখানার দিকে ছুটলাম। সামনে ছিলো ডোবা। সেই ডোবায় না জানি কী আছে না আছে। আমরা কয়েকজন সেই ডোবায় লাফ দিলাম। দৌড়াতে শুরু করলাম রুদ্ধশ্বাসে। পেছনে ফায়ারের শব্দ শুনলাম। ডোবায় কাদা মাখিয়ে বেশ কয়েকবার ডুবে যেতে গিয়েও কোনোরকমে উঠে দৌড়াতে থাকলাম। সামনে পড়লো বিশাল উঁচু দেয়াল। সেই দেয়াল যে কীভাবে টপকেছি, এখন আমি মনে করতে পারি না। সেই সময়টুকুর স্মৃতি আমার নেই। সেই দেয়াল টপকাতে গিয়ে কয়েক জায়গায় ছেঁচে গেছিলো। লাফ দিয়ে পা-ও মচকেছিলো। এরপরও ছুটেছি। অনেক দূর দৌড়ানোর পর একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাড়ির মহিলারা দ্রুত এসে আমাদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে ফেললেন। লীগের সন্ত্রাসীদের একটা গ্রুপ তখন আমাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার স্মৃতি নেই কে বা কারা সেদিন আমার সাথে ছুটেছিলো, আমাকে যারা তাদের রান্নাঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন তারাই বা কারা, কিন্তু তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বেশ কিছু সময় পর আমি সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে অল্টারনেটিভ রুটে বাজারে উঠে সরাসরি ফুফুদের বাড়ি চলে যাই। আমার পায়ে জুতো নেই, আপাদমস্তক কাদা আর শরীরে বিভিন্ন জায়গায় আঘাত। ফুফুদের বাড়িতে গিয়ে আমি সোফায় ঠায় বসে রইলাম। স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কী ঘটছে। এদিকে বন্ধুদের খবর পাচ্ছিলাম না, যারা ভেতরে আছে। ফোন দিলাম, হাসানকে পেলাম। হাসান বললো, বের হয়েছে। বাকি ক্লাসমেটরাও বের হয়েছে খবর পেলাম। আহত হয়েছে অনেকে। কিন্তু, বের হতে পারেনি আমার আরো কিছু শিবিরের ভাই-বন্ধু। মাদ্রাসার প্রাঙ্গনে তাদেরকে পিটিয়ে কারো কোমর ভেঙে দেয়া হয়েছে, কারো পা থেতলে দেয়া হয়েছে, কারো মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেই আহত অবস্থায় পুলিশ ডেকে তাদেরকে পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর টিভিতে নিউজ এলো।  “দাগনভূইয়ার আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় গোপন মিটিং চলাকালীন পেট্রোল বোমা আর ককটেলসহ জামায়াত-শিবিরের ৭০ জন নেতাকর্মী আটক”। আমি অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম টিভি স্ক্রিনের দিকে। আমি কিশোর মন সেদিন চুরমার হয়ে গেছে সেটা দেখে। সেদিনের পর থেকে বাংলাদেশের মিডিয়াকে আমি আর কোনোদিন বিশ্বাস করিনি। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর আমি শিবির ছেড়ে দেই। শিবিরের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। কার্যত সেদিনের পর থেকে শিবির বা জামায়াতের রাজনীতির সাথে আমি আর যুক্ত থাকিনি।

আজ বহুবছর পর এসে আমি আমার সেই সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করি। কেন আমি শিবির ছাড়লাম? কী কারণ ছিলো? কখনো মনে হয়, ছেড়ে দেয়াই কি স্বাভাবিক ছিলো না? ঐ কিশোর বয়সে আমি যেই পরিমাণ টর্চারের স্বীকার হয়েছি, যেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলোর সম্মুখীন হয়েছি, এর পর কি আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো কন্টিনিউ করা? আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। বাবা-মায়ের এক বুক স্বপ্ন। ভালো কিছু করবো। বড় কিছু হবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি, চাকরি করছি প্রায় বছর তিনেক। শিবির করলে কি আজ এই জায়গায় থাকতে পারতাম? হয়ত, কোনো এক মিছিলে গুলি খেয়ে মরে যেতাম। নয়তো কখনো বাসা থেকে তুলে নিয়ে গুম করতো। নয়তো কখনো কোনো মিটিং-এ হামলা করে অস্ত্র মামলা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিতো। একবার মামলা খেলে, আর কি ক্যারিয়ার হতো আমার? কোথায় থাকতাম আমি?

আবার কখনো ভাবি, আমি ভীতু, কাপুরুষ। আমি যেই সংগ্রামী কবিতা লিখতাম, সংগ্রামের গান শুনতাম, সেগুলো মিছে। আমি নিজের সাথে, নিজের ভ্যালুজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। আমার মত আরো অনেকেই তো ছিলো। পা থেতলে যাওয়ার পর আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। মামলার পর মামলা খেয়ে বাড়ি ছাড়া হয়েছে, ইসলামী আন্দোলন ছাড়েনি। আমার মত অনেকে তো সন্ত্রাসী লীগের গুলিতে শহীদ হয়ে গেছে। তাহলে আমি কেন ছেড়ে দিলাম? নিশ্চয়ই আমি দুর্বল। নিঃসন্দেহে আমি ভীতু।

এই যুদ্ধ প্রতিনিয়ত আমার নিজের সাথে নিজের। আমি বহুবার নিজের সাথে নিজে তর্ক করেছি। জিতেছি, হেরেছি। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাকে কে দেবে? আমি তো একজন কিশোর ছিলাম মাত্র। জীবন সবে শুরু হয়েছিলো। পড়াশোনা করতাম। একটা ছাত্র সংগঠনকে পছন্দ করতাম, তাই যুক্ত হয়েছিলাম। তাহলে কেন আমাকে এসবের ভেতর দিয়ে যেতে হলো? কেন আমার কৈশোরকে এভাবে বিষাক্ত বানানো হলো? কেন আমার কৈশোরের সহজতা, উচ্ছ্বলতা, আনন্দ সব কেড়ে নেয়া হলো। কেন আমার ওপরে বুলেট আসলো, কেন আমাকে স্কুল পালাতে হলো, কেন আমার কৈশোর আর দশজনের মত স্বাভাবিক হলো না। কেন সেই কিশোর বয়সেই আমাকে এটা বুঝিয়ে দেয়া হলো যে কিছু নির্দিষ্ট চিন্তার, কিছু নির্দিষ্ট আদর্শের মানুষের জীবন বাকিদের মত মূল্যবান নয়, মূল্যবান নয় তাদের শৈশব, কৈশোর৷ কেন আমি ‘নামানুষ’, ‘হোমো স্যাকার’ কী না জানার বয়সে সেই অনুভূতি পেয়েছি? এই প্রশ্ন আমার না, এই প্রশ্ন আমার মত শিবির করা হাজার হাজার ছেলের। আমার চেয়েও তিক্ত, আমার চেয়েও ভয়াবহ, দুঃসহ স্মৃতি যাদের আছে। তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? তাদেরকে কে বলবে, তাদের অপরাধ কী?”

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আসিফ মাহমুদ

“কেন আমি শিবির ছাড়লাম?” শিরোনামে লেখক আসিফ মাহমুদের বেদনাদায়ক স্মৃতিচারণ

প্রকাশিত: ১১:১৩:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তরুণ লেখক আসিফ মাহমুদ সম্প্রতি তার ফেসবুক পোস্টে এক বেদনাদায়ক স্মৃতিচারণ করেছেন, যেখানে তিনি কেন ছাত্রশিবির ত্যাগ করেছেন তা বর্ণনা করেছেন। কৈশোরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাগুলোর কথা তিনি তুলে ধরেছেন, যা তাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

​আসিফ তার লেখায় জানান, তিনি স্কুলজীবনে কীভাবে  ইসলামিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বন্ধুদের প্রভাবে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত হন। একজন নিয়মিত ছাত্র থেকে তিনি সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন। তার কথায়, এ সময় তিনি সাংগঠনিক নিয়মকানুন মেনে চলা এবং ধর্মীয় পড়াশোনায় মনোযোগী হন, যা তার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ছাত্রশিবির নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন স্মৃতিচারণমূলক একটি পোস্ট দেন আসিফ মাহমুদ। যেখানে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।

তার পোস্ট করা ফেসবুকের লেখাটি হল-

“কেন আমি শিবির ছাড়লাম?

(১)

২০১২ সালের শেষের দিকের কথা। ক্লাস নাইন শেষ হবে হবে করছে। আমি তখন তুমুল কবি। ঝড়ো কবিতা লিখি। সেই কবিতাগুলো একটা ডায়েরি, দিস্তা কাগজের পাতা, নোটপ্যাডের পাতা – এসব জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ছিলো। আমি সবগুলোকে একত্র করে একটা ফাইলে রাখতাম। ফাইলটা হারিয়ে ফেলেছি, ভেবে খুব মন খারাপ হয়।  লিখতাম ইসলামী কবিতা, প্রতিবাদী কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা। গদ্যছন্দ বুঝতাম না। তবুও গদ্যছন্দে কিছু কবিতা লেখার বৃথা চেষ্টাও করেছিলাম। একটা প্যাটার্ন কমন ছিলো। কবিতাগুলোয় ‘বিপ্লবী’ ধাঁচ ছিলো। নবম শ্রেণীর একজন ছাত্রের কাছে ‘বিপ্লব’ যতখানি আরকি। এরকম লেখালিখির কারণ ছিলো আমি ধার্মিক পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা, সেখানে ইসলামের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর পাশাপাশি ‘পলিটিকাল ইসলাম’ এর আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিলো। এভাবে বেড়ে ওঠার কারণেই হয়ত আমি ঐ ধাঁচের লেখা লিখতাম, ঐ ধাঁচের চিন্তা করতাম। তো, ‘১২ সালের শেষদিকে এসে আমি আমার বন্ধু মোকারমের সাথে প্রায়ই আমার চিন্তা শেয়ার করতাম। সেইসময় দেশের রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ট্রায়াল চলছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে’। সারাদেশে চলছে ‘জামায়াত-শিবির’ বিরোধী তুমুল ক্যাম্পেইন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলো শাহবাগ। সেই টালমাটাল সময়ে আমার আর মোকারমের আড্ডা হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দেশের রাজনীতি নিয়ে, ইসলাম নিয়ে। মোকারম ছিলো শিবিরের সাথী। ও যখনই আমাকে শিবিরে যোগ দিতে বলতো, আমি একের পর এক প্রশ্ন করতাম। ‘নারী নেতৃত্ব’, ‘গণতন্ত্র’, ‘দাঁড়ি ছোট রাখা’ –এসব ব্যাপার নিয়ে তর্ক করতাম। মোকারম সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো না। কারণ, বলাই বাহুল্য, সেও আমার মত নবম শ্রেণীতেই পড়ে।

(২)

কিন্তু, ওর সাথে আলাপচারিতার সময়েই আমার একটা পর্যায়ে মনে হয় আমার শিবিরে যাওয়া উচিত। এরপর, যা ভাবা তাই কাজ। প্রথমে সমর্থক, তারপর কর্মী হয়ে গেলাম। কর্মী হওয়ার পর একটা বড় রিপোর্ট বই ধরিয়ে দিলো। বিপাকে পড়লাম। নামাজের হিসাব, কুরআন পড়ার হিসাব, হাদীস পড়ার হিসাব, বই পড়ার হিসাব। হিমশিম খেতাম। সাথী হওয়ার শর্ত ছিলো টানা তিন মাস কোনো নামাজ মিস করা যাবে না। আমি টানা কয়েকটা তিন মাসের সাইকেল আপ্রাণ চেষ্টা করেও ঠিক রাখতে পারিনি। দুয়েকটা ফজর মিস হয়েই যেত। বইগুলো পড়তাম। কুরআন শুদ্ধ করে পড়া শিখলাম। বেশ অনেকগুলো আয়াত মুখস্ত করলাম সিলেবাসের কল্যাণে। হাদীসও মুখস্ত হয়ে গেল অনেকগুলো। শিবিরের কল্যাণেই এত নিয়মিত বেসিসে আমি কুরআন-হাদীস পড়েছি সেসময়, তাগাদা নিয়ে কুরআন শুদ্ধ করেছি –এসব মনে পড়লে ওদের জন্য দোয়া আসে। দিন গড়ায়, দশম শ্রেণীতে উঠি। চলে আসে উত্তাল ’১৩ সাল। শিবিরের সেটাপ হয়। আমাকে স্কুল শাখার ‘ছাত্র কল্যাণ সম্পাদক’ বানিয়ে দেয়া হয়। আমি নাকি দায়িত্বশীল! আমি নামাজ মিস করি। গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না। পারিনা কারো সাথে গিয়ে নিজে থেকে মিশতে, বন্ধুত্ব পাতাতে। সেখানে ‘দাওয়াতি’ কাজ তো বহু দূর কি বাত! তার ওপর আমি রেবেল। প্রোগ্রামে গিয়ে জেলা থেকে আসা, মহানগর থেকে আসা শিবিরের দায়িত্বশীলদের কড়া কড়া প্রশ্ন করি। তারা বোধহয় ভাবেন, এই পিচ্চি ছেলে এসব কী বলে! নূরনবী ভাই মুচকি মুচকি হাসেন। নূরনবী ভাই তখন থানা সভাপতি। আমি আজ পর্যন্ত উনার মত আন্তরিক আর ভদ্র মানুষ আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হাসিমুখে কথা বলেন, দেখা হলেই জড়িয়ে ধরেন। পড়াশোনা করতে বলেন। শিবির ছেড়ে আসার পরও সবসময় অমায়িক ব্যবহারই পেয়েছি তার কাছে। তো এসবের পরও আমি যখন ‘দায়িত্বশীল’ হয়ে গেলাম, তখন মনে হলো – কিছু দায়িত্ব নিতে হবে এবার। আমি আর মোকারম মিলে ইন্ডিভিজুয়ালি ক্লাসের অনেকের সাথে ওয়ান টু ওয়ান বসতাম। দিনের পর দিন সময় দিতাম। সেটার রেজাল্ট দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই। আমাদের ক্লাসেই প্রায় ২০ জনের অধিক কর্মী হয়ে যায় মাত্র কয়েক মাসে। যারা হয় না, তারাও প্রোগ্রামে যায়, বই পড়ে, একসাথে নামাজে যায়। আতাতুর্ক স্কুলের ১৪তম ব্যাচের নামই পড়ে গিয়েছিলো ‘শিবির ব্যাচ’। গল্পের মত না? কিন্তু এর পরপরই শুরু হয় ভয়ঙ্কর দিনগুলো।

(৩)

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় দেয়ার পর ঢাকায় বসে যায় গণজাগরণ মঞ্চ। সেই ভয়ঙ্কর শাহবাগ, তখনো জানতাম না – এটা জন্ম দিতে যাচ্ছে এক অনিঃশেষ ফ্যাসিবাদের। শাহবাগে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সারা বাংলাদেশে একটা ‘জামায়াত-শিবির বিরোধী’ ওয়েভ শুরু হয়। এর আগে কার্যত আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগের তৃণমূলে তেমন আধিপত্য ছিলো না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ফাংশন করছিলো এজ ইউজুয়াল। কিন্তু, শাহবাগ শুরু হওয়ার পর জামায়াত এবং শিবিরকে ক্রমাগত ডিমনাইজ এবং ডিহিউম্যানাইজ করা শুরু হয়। ‘বুদ্ধিজীবীরা’ বয়ান উৎপাদন করতে শুরু করেন, শাহবাগ ‘মব ভয়েস’ এর মাধ্যমে সেই বয়ান ছড়ায়, মিডিয়াগুলো সেটাকে এমপ্লিফাই করে। আর এরপরই সরকার শুরু করে দমন-পীড়ন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় ক্র‍্যাকডাউন। আমাদের স্কুলও ব্যতিক্রম ছিলো না। চেয়ারম্যান সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। তার দরকার ছিলো একটা লিস্ট। সেই লিস্টটা পেয়ে যায় আমাদেরই একজন ব্যাচমেট থেকে। আমাদের ক্লাসে গুণেগুণে দুইজন ‘শাহবাগী’ ছিলো। একজন বংশগতভাবে আওয়ামীলীগ, রিজিড এবং ভায়োলেন্ট। অন্যজন কিছুটা লেস রিজিড, কিন্তু লীগ। এই দুইজনের সাথে শাহবাগের সময়ে আমাদের ভীষণ তর্ক হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলের করিডোরে, খেলার মাঠে, নাস্তার টেবিলে। সবখানে। শাহবাগের সাজানো রায় নিয়ে তর্ক, শাহবাগিদের ব্লাসফেমি নিয়ে তর্ক, পরবর্তীতে হেফাজতে ইসলামের উপর গণহত্যার সময়কালীন ঘটনা নিয়ে তর্ক। তর্ক চলতেই থাকতো। কিন্তু, কখনো সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে যায়নি। বন্ধু হিসেবেই দেখতাম। আমরা তার কোনো ক্ষতি কখনো করবো না এটা ডেটারমাইন্ড ছিলাম, আর সে যে কখনো আমাদের ক্ষতি করবে না –এমন আত্মবিশ্বাসই ছিলো। কিন্ত, আল্টিমেটলি সে স্কুলে কারা শিবিরকে লিড দিচ্ছে, তাদের একটা লিস্ট চেয়ারম্যানের কাছে তুলে দেয়। এরপর শুরু পালিয়ে বেড়ানোর দিন..

(৪)

আমাদের শিক্ষকরা আমাদের ব্যাপারে খুব সাপোর্টিভ ছিলেন। অনেকেই জানতেন আমরা কারা শিবির করি। নামাজ পড়তাম, ভালো আচরণ করতাম, ক্লাসেও টপার ছিলাম – তাই পছন্দ করতেন। একদিন, সবে প্রথম পিরিয়ড শেষ হলো। ক্লাসে বসে আছি। একজন স্যার আমাকে ক্লাসের বাইরে থেকে ডাকলেন। আমি গেলাম, সালাম দিলাম। স্যারকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছিলো। স্যার বললেন, “তোমাদের যারা আছে, সবাইকে নিয়ে সরে যাও, আজকে আর স্কুলে থাকার দরকার নাই। বাসায় চলে যাও। আজকে রেইড হবে। চেয়ারম্যান আসবে, পুলিশ আসবে।” ভাবতে পারেন? আমরা সবে ক্লাস টেনে পড়ি। আমাদের মত বাচ্চা ছেলেদের ধরতে স্কুলে পুলিশ আসবে, চেয়ারম্যান আসবে। একে একে সবাইকে নিয়ে সেদিন সরে পড়ি। কিন্তু, এরপর থেকে প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছিলো এই ঘটনা। আমার মনে পড়ে না ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষ অবধি কখনো শান্তিতে ক্লাস করতে পেরেছি কীনা। একেকদিন ফিফথ পিরিয়ডে, থার্ড পিরিয়ডে ব্যাগ বই গুছিয়ে পালাতে হয়েছে। আর বাকি দিনগুলোতে ছিলো ছাত্রলীগ আতঙ্ক। ইনফরমেশন পেতাম, ছাত্রলীগ স্কুল গেইটে অবস্থান নিয়েছে। দেখতে পেলেই মারবে। কোনোদিন দেয়াল টপকে বের হতাম। কোনোদিন ভিড়ের মধ্যে মিশে বের হতাম। আমরা ছিলাম ক্লাসের টপার, স্কুলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছাত্র, শিক্ষকদের আদরের পাত্র। তারপরও কেবল শিবির করার ‘অপরাধে’ আমরা হয়ে গিয়েছিলাম ঊনমানুষ। আমরা সাপোর্টিভ শিক্ষক পেয়েছিলাম বলে টিকে গেছিলাম, নাহলে অসংখ্যবার আমাদেরকে হাসপাতালে যেতে হত, খাটতে হতো জেল। আমি তখন বারবার ভাবতাম, কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? আমি তো কাউকে মারছি না। কারো ক্ষতি করছি না। একটা সংগঠনের রাজনীতি ভালো লাগে আমার, তাই সেই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি। এটা কি অপরাধ? কেন আমাকে মারবে? কেন জেলে দেবে? আমরা কি আদৌ স্বাধীন?

(৫)

২০১৩ সাল আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তাল সময়। বিশেষত, সাঈদী সাহেবের রায়ের দিনের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। সারাদিনে জামায়াত এবং শিবিরের প্রায় ৭০-৮০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ লীগ আর আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা গুলি করে মেরে ফেলে। সারাদিন মৃত্যুর সংবাদ শুনি, কান্না করি। চট্টগ্রামে কোমরের কাছে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার ভিডিও দেখে মন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। আব্বু-আম্মুর কড়া নিষেধাজ্ঞায় সেদিন মিছিলে যেতে পারিনা। কিন্তু, সেদিনের সেই ভয়াবহ গণহত্যা দেখার পর সিদ্ধান্ত নেই, আর আব্বু-আম্মুর নিষেধের তোয়াক্কা করবো না। তড়িৎ সিদ্ধান্ত। তখনো জানিনা, এই সিদ্ধান্ত কোনো একদিন আমার জীবনে একটা অন্ধকার দিন নামিয়ে আনবে।

সাঈদীর সাহেবের রায়ের পর থেকে প্রতিটি বিক্ষোভ মিছিলে যেতাম। গলার রগ ফুলিয়ে ‘তাকবীর’ দিতাম। রোদের ঝাঁঝে গা জ্বলতো, ঘাম আর কান্না মিশে যেতো। অদূরে পুলিশ বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে থাকতো। মৃত্যু দেখতাম চোখের সামনে। কখনো সেই মৃত্যু আমাদের ধাওয়া দিতো। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতাম। যেই সাহস আর শক্তি নিয়ে আম্মুর নিষেধকে অমান্য করে আসতাম, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই সাহস আর শক্তি থাকতো না। ভয় পেতাম, পা কুঁকড়ে আসতো। দূর থেকে শুনতে পেতাম আবছা আবছা গান, যা শুনে একসময় আন্দোলিত হয়েছি,

“সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে, আমাকেও রাখিও রহমান,
যারা কোরআনের আহ্বানে নির্ভিক, নির্ভয়ে সব করে দান”

সেই গান ক্রমাগত দূরে সরে যেত। গানের জায়গায় বাজতো বুকের ধুকপুক শব্দ। সাহসের স্থানে সেখানে জায়গা করে নিয়েছিলো ভয়। কিন্তু, কফিনে শেষ পেরেক তখনো বাকি ছিলো।

(৬)

২০১৫ সালের কোনো এক বিকেল। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সবে, অথবা সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুরা মাঠে ক্রিকেট খেলছি। মোকারমকে সাথে করে আমাদের স্কুল সভাপতি এলেন। এসে বললেন, আসরের পর আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার মাঠে শহীদ কামারুজ্জামানের গায়েবানা জানাযা হবে, আমরা যারা চাই, তারা যেন যাই। আসরের আজান হওয়ার পর আমরা মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে যাই। ওজু করে বসে থাকি নামাজের অপেক্ষায়। মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে অনেক মানুষ। আলেম ওলামা, শিবিরের ছেলেরা, জামায়াতের লোকেরা, সাধারণ মুসল্লিসহ অনেকে। মাদ্রাসা গমগম করছে। মাদ্রাসার সাথে লাগোয়া মসজিদ, চারপাশে ঘেরা। বের হওয়ার রাস্তা একটা, আর ওজুখানার পাশে ডোবা। আমাদের কল্পনায়ও ছিলো না এক ভয়ঙ্কর আজাব সেদিন নেমে আসবে। বারান্দায় জায়গা পেলাম, সেখানেই দাঁড়িয়েছি নামাজে। দুই রাকাত শেষ হওয়ার পরই অনেক লোকের গলার আওয়াজ, অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনতে পাই। তখনও ঘটনার ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারিনি। শেষ বৈঠকে বসেছি। ডানদিকে সালাম ফেরালাম, সবার আগে চোখে পড়লো একটা প্রকাণ্ড রাইফেল। সালাম ফিরিয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য। আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যানের হাতে হ্যান্ডগান। ছাত্রলীগের কয়েকজন সন্ত্রাসীর হাতে বড় বন্দুক। আর মেইনগেইট ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধশত সন্ত্রাসী। সবার হাতে দেশী অস্ত্র, রড, পাশের সমেইল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠ। মূহুর্তের মধ্যে আমার জগৎ এলোমেলো হয়ে গেল। চেয়ারম্যান সাহেব বন্দুক উঁচিয়ে দুইটা ফায়ার করলেন, অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললেন “সবাইকে ধরতে”। শুরু হয়ে গেলো ছোটাছুটি। সবাই ছিটকে মাদ্রাসা আর মসজিদের ভেতর ঢুকতে লাগলো। আর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ঝাপিয়ে পড়লো। আমরা চিহ্নিত শিবির। ধরা পড়লে বাঁচার উপায় নেই। ওজুখানার দিকে ছুটলাম। সামনে ছিলো ডোবা। সেই ডোবায় না জানি কী আছে না আছে। আমরা কয়েকজন সেই ডোবায় লাফ দিলাম। দৌড়াতে শুরু করলাম রুদ্ধশ্বাসে। পেছনে ফায়ারের শব্দ শুনলাম। ডোবায় কাদা মাখিয়ে বেশ কয়েকবার ডুবে যেতে গিয়েও কোনোরকমে উঠে দৌড়াতে থাকলাম। সামনে পড়লো বিশাল উঁচু দেয়াল। সেই দেয়াল যে কীভাবে টপকেছি, এখন আমি মনে করতে পারি না। সেই সময়টুকুর স্মৃতি আমার নেই। সেই দেয়াল টপকাতে গিয়ে কয়েক জায়গায় ছেঁচে গেছিলো। লাফ দিয়ে পা-ও মচকেছিলো। এরপরও ছুটেছি। অনেক দূর দৌড়ানোর পর একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাড়ির মহিলারা দ্রুত এসে আমাদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে ফেললেন। লীগের সন্ত্রাসীদের একটা গ্রুপ তখন আমাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার স্মৃতি নেই কে বা কারা সেদিন আমার সাথে ছুটেছিলো, আমাকে যারা তাদের রান্নাঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন তারাই বা কারা, কিন্তু তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বেশ কিছু সময় পর আমি সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে অল্টারনেটিভ রুটে বাজারে উঠে সরাসরি ফুফুদের বাড়ি চলে যাই। আমার পায়ে জুতো নেই, আপাদমস্তক কাদা আর শরীরে বিভিন্ন জায়গায় আঘাত। ফুফুদের বাড়িতে গিয়ে আমি সোফায় ঠায় বসে রইলাম। স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কী ঘটছে। এদিকে বন্ধুদের খবর পাচ্ছিলাম না, যারা ভেতরে আছে। ফোন দিলাম, হাসানকে পেলাম। হাসান বললো, বের হয়েছে। বাকি ক্লাসমেটরাও বের হয়েছে খবর পেলাম। আহত হয়েছে অনেকে। কিন্তু, বের হতে পারেনি আমার আরো কিছু শিবিরের ভাই-বন্ধু। মাদ্রাসার প্রাঙ্গনে তাদেরকে পিটিয়ে কারো কোমর ভেঙে দেয়া হয়েছে, কারো পা থেতলে দেয়া হয়েছে, কারো মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেই আহত অবস্থায় পুলিশ ডেকে তাদেরকে পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর টিভিতে নিউজ এলো।  “দাগনভূইয়ার আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় গোপন মিটিং চলাকালীন পেট্রোল বোমা আর ককটেলসহ জামায়াত-শিবিরের ৭০ জন নেতাকর্মী আটক”। আমি অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম টিভি স্ক্রিনের দিকে। আমি কিশোর মন সেদিন চুরমার হয়ে গেছে সেটা দেখে। সেদিনের পর থেকে বাংলাদেশের মিডিয়াকে আমি আর কোনোদিন বিশ্বাস করিনি। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর আমি শিবির ছেড়ে দেই। শিবিরের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। কার্যত সেদিনের পর থেকে শিবির বা জামায়াতের রাজনীতির সাথে আমি আর যুক্ত থাকিনি।

আজ বহুবছর পর এসে আমি আমার সেই সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করি। কেন আমি শিবির ছাড়লাম? কী কারণ ছিলো? কখনো মনে হয়, ছেড়ে দেয়াই কি স্বাভাবিক ছিলো না? ঐ কিশোর বয়সে আমি যেই পরিমাণ টর্চারের স্বীকার হয়েছি, যেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলোর সম্মুখীন হয়েছি, এর পর কি আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো কন্টিনিউ করা? আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। বাবা-মায়ের এক বুক স্বপ্ন। ভালো কিছু করবো। বড় কিছু হবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি, চাকরি করছি প্রায় বছর তিনেক। শিবির করলে কি আজ এই জায়গায় থাকতে পারতাম? হয়ত, কোনো এক মিছিলে গুলি খেয়ে মরে যেতাম। নয়তো কখনো বাসা থেকে তুলে নিয়ে গুম করতো। নয়তো কখনো কোনো মিটিং-এ হামলা করে অস্ত্র মামলা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিতো। একবার মামলা খেলে, আর কি ক্যারিয়ার হতো আমার? কোথায় থাকতাম আমি?

আবার কখনো ভাবি, আমি ভীতু, কাপুরুষ। আমি যেই সংগ্রামী কবিতা লিখতাম, সংগ্রামের গান শুনতাম, সেগুলো মিছে। আমি নিজের সাথে, নিজের ভ্যালুজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। আমার মত আরো অনেকেই তো ছিলো। পা থেতলে যাওয়ার পর আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। মামলার পর মামলা খেয়ে বাড়ি ছাড়া হয়েছে, ইসলামী আন্দোলন ছাড়েনি। আমার মত অনেকে তো সন্ত্রাসী লীগের গুলিতে শহীদ হয়ে গেছে। তাহলে আমি কেন ছেড়ে দিলাম? নিশ্চয়ই আমি দুর্বল। নিঃসন্দেহে আমি ভীতু।

এই যুদ্ধ প্রতিনিয়ত আমার নিজের সাথে নিজের। আমি বহুবার নিজের সাথে নিজে তর্ক করেছি। জিতেছি, হেরেছি। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাকে কে দেবে? আমি তো একজন কিশোর ছিলাম মাত্র। জীবন সবে শুরু হয়েছিলো। পড়াশোনা করতাম। একটা ছাত্র সংগঠনকে পছন্দ করতাম, তাই যুক্ত হয়েছিলাম। তাহলে কেন আমাকে এসবের ভেতর দিয়ে যেতে হলো? কেন আমার কৈশোরকে এভাবে বিষাক্ত বানানো হলো? কেন আমার কৈশোরের সহজতা, উচ্ছ্বলতা, আনন্দ সব কেড়ে নেয়া হলো। কেন আমার ওপরে বুলেট আসলো, কেন আমাকে স্কুল পালাতে হলো, কেন আমার কৈশোর আর দশজনের মত স্বাভাবিক হলো না। কেন সেই কিশোর বয়সেই আমাকে এটা বুঝিয়ে দেয়া হলো যে কিছু নির্দিষ্ট চিন্তার, কিছু নির্দিষ্ট আদর্শের মানুষের জীবন বাকিদের মত মূল্যবান নয়, মূল্যবান নয় তাদের শৈশব, কৈশোর৷ কেন আমি ‘নামানুষ’, ‘হোমো স্যাকার’ কী না জানার বয়সে সেই অনুভূতি পেয়েছি? এই প্রশ্ন আমার না, এই প্রশ্ন আমার মত শিবির করা হাজার হাজার ছেলের। আমার চেয়েও তিক্ত, আমার চেয়েও ভয়াবহ, দুঃসহ স্মৃতি যাদের আছে। তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? তাদেরকে কে বলবে, তাদের অপরাধ কী?”

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আসিফ মাহমুদ