বহু পূর্ব থেকেই মৌলভীবাজার তথা সিলেটের মানুষ লন্ডনে যাবার জন্য জন্মের পর থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করে। মোটামুটি কলেজের এইচএসসি শেষ করতে পারলে পড়াশোনা নিয়ে অধিকাংশই আর পড়ার দিকে এগোতে চায় না। অনেকেই বিয়ে করে, অনেকে আবার ছাত্র ভিসায়, অনেকেই ওয়ার্ক পারমিটে বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। এখানে বিসিএস-এর পরীক্ষা কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়া বা বড় কোন চাকরিজীবী হওয়ার স্বপ্ন অনেকেই পোষণ করেন না। বিসিএস কিংবা চাকরিজীবীর চেয়েও সম্মান আর গৌরব হচ্ছে লন্ডন-আমেরিকা বা প্রবাসের বাসিন্দা হওয়া। আমাদের এই মনোভাবের কারণে দেশে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম আর এই জন্যই চাকরির বাজারে আমাদের মূল্য অনেক নগণ্য ও সীমিত।
সিলেটিদের এই স্বপ্নকে পুঁজি ও হাতিয়ার বানিয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল এক আদম ব্যবসার বা দালালের চক্র। যারা মানুষকে লন্ডন কিংবা বিদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি আদালতে ও থানায় এ সংক্রান্ত ভিসা জালিয়াতি ও প্রতারণার কারণে দায়ের হয়েছে প্রচুর মামলা। তাছাড়া প্রতিনিয়ত বিচার সালিশতো আছেই।
মামলার ঘটনার বিষয় প্রায় একই। যেমন : দালাল চক্র ওয়ার্ক পারমিট ভিসা বা অন্য কোনো দেশের ভিসা দেওয়ার কথা বলে অগ্রিম টাকা নিয়েছে, টাকা নেওয়ার পরে জাল ভিসা বা কস লেটার ইস্যু করে আবার অনেককে কস লেটার বা ভিসা দিতে পারে নাই। এখন দালাল চক্র কোনো ভুক্তভোগীকে ভিসা কিংবা টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। অনেক দালাল প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে। অধিকাংশ প্রতারণা এবং আত্মসাৎ দেশে-বিদেশের লোক মিলে যৌথভাবে করা হচ্ছে। বিদেশে যার মাধ্যমে ভিসা দেওয়ার কথা ছিল সে দেশে থাকা তার কোনো আত্মীয় কিংবা এজেন্সির লোকের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে। অনেকেই নগদ টাকা দিয়েছে, আবার অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতারক চক্রকে টাকা পরিশোধ করেছে। বর্তমানে মামলা দায়ের করা হলেও মূল প্রতারক প্রবাসে থাকার কারণে টাকা উদ্ধার কিংবা তাদেরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না বা জোরালো আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভবপর হচ্ছে না।
অনেক ভুক্তভোগী জমিজমা বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন আবার অনেকে হারিয়েছেন তাদের শেষ সম্বল। ভুক্তভোগীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে এবং অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ প্রতারক চক্র অসহায় মানুষগুলোর নিকট থেকে টাকা নিয়ে ঠিকই প্রবাসে আরামে জীবন যাপন করছেন। আবার অনেকেই আলিশান বাড়ি নির্মাণ করে বিলাসিতা করছেন। প্রকৃতপক্ষে এরা মানুষরূপী অমানুষ।
যেহেতু দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়াই একমাত্র মাধ্যম হিসেবে সবাই বিবেচনা করে থাকেন, সেহেতু আপনাদের দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসরণ করা উচিত।
(১) আলোচনার মাধ্যমে অবশ্যই একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করবেন। চুক্তির মধ্যে অবশ্যই ভিসা দাতা, তার পরিবারের সদস্য অর্থাৎ বিশেষ করে তার বউ, মা, ভাই যেকোনো একজনসহ পক্ষ ভুক্ত করবেন।
(২) যদি খরচ বাবদ বিচার পূর্বে কিছু টাকা দিতেই হয় তাহলে অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে ভিসা দাতাকে টাকা পরিশোধ করবেন। যিনি আপনাকে বিদেশ নিবেন যদি তিনি প্রবাসে থাকেন তাহলে তার দেশে থাকা ভাই/মা/বাবা কিংবা বউয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পরিশোধ করবেন।
(৩) ভিসা না হওয়ার পূর্বে এবং ভিসা হাতে না পেয়ে কখনোই সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করবেন না। যদি ভিসা প্রদান করে সেক্ষেত্রে ভিসাটি সঠিক কিনা যাচাই করে নিবেন।
(৪) চুক্তি সম্পাদনের সময় ভিসা দাতার কিংবা তার পরিবারের নিকট থেকে এই মর্মে একটি চেক গ্রহণ করবেন যে, যদি সে বিদেশে নিতে না পারে সেক্ষেত্রে ইস্যুকৃত চেক এর মাধ্যমে আপনার পরিশোধিত টাকা ফেরত প্রদান করবে।
(৫) যিনি প্রবাস থেকে আপনাকে ভিসা প্রদান করবেন তার ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের কপি আপনার সংগ্রহে রাখবেন।
বিদেশ যাবেন সমস্যা নেই পড়াশোনাটা শেষ করে যেতে পারেন তাতে আপনার নিজের এবং দেশের উপকারে আসবে, ৩০-৪০ লাখ টাকা খরচ করে কিংবা ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে বিদেশের চিন্তা না করে এই টাকা দেশে ইনভেস্ট করতে পারেন। বিদেশ যদি যেতেই হয় বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, দালালের খপ্পরে পড়ে সম্বল যাতে না হারাতে হয় লক্ষ্য রাখবেন। সরকারের উচিত বিদেশগামী বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে যারা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন তাদের জন্য অচিরেই একটি নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেওয়া এবং দালালের লাগাম টেনে ধরা।
লিখেছেন এড. নিয়ামুল হক
অতিরিক্ত পিপি, মৌলভীবাজার জজ কোর্ট।