আমরা প্রায়শই রাস্তায় এক ধরনের দৃশ্য দেখি বাইকাররা দ্রুতগতিতে লেন পরিবর্তন করছে, বিকট শব্দে হর্ন বাজাচ্ছে, ফুটপাতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, এবং অন্য চালকদের সাথে উগ্র ব্যবহার করছে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকের মনেই এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে বাইকার মানেই এক ধরণের উগ্র, বেয়াদব বা বেপরোয়া চালক।
কিন্তু আমরা যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করি, তাদের জন্য চালচলন বা আচরণের মাপকাঠি হলো ইসলাম। ইসলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিনয়, নম্রতা ও দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দেয়। তাহলে, আপনার প্রিয় বাহনটি কি আপনাকে সেই ইসলামিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে!
একজন মুমিন বাইকারের আচরণ কেমন হওয়া উচিত-
অহংকার নয়: নম্রতা–
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: “আর দয়াময় আল্লাহর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৩)
এখানে ‘নম্রভাবে চলাফেরা’ বলতে শুধু পায়ে হাঁটাকে বোঝানো হয়নি, বরং জীবনের প্রতিটি গতি, চলার ধরণ এবং আচরণে বিনয় ও অহংকারমুক্ত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা কেবল ট্রাফিক আইন মানা নয়, বরং নিজের নফস-এর ওপর বিজয় ঘোষণা করা। যখন আপনার বাইক সর্বোচ্চ গতিতে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, আর আপনি স্বেচ্ছায় আল্লাহর নির্দেশের কারণে গতি কমান, তখনই আপনি প্রকৃত শক্তিশালী ও বিনয়ী মুমিন।
নবী করীম (সা.) বলেছেন, “যার হৃদয়ে সরিষার দানা পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহীহ মুসলিম: ৯১)
বেপরোয়াভাবে ওভারটেক করা বা বিপজ্জনকভাবে পথ চলার মাধ্যমে অনেকে নিজেকে মুহূর্তের জন্য “হিরো” ভাবতে পারে। কিন্তু এই এক সেকেন্ডের হিরোইজম চিরস্থায়ী আফসোসে পরিণত হতে পারে। বেপরোয়া গতি, উচ্চ শব্দে বাইক চালানো এবং অন্যদের তুচ্ছ করে ওভারটেক করার প্রবণতা এগুলো বিনয়ের অভাব এবং এক ধরণের অহংকার প্রকাশ করে। এই আচরণের মাধ্যমে আপনি শুধু জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন না, বরং আপনার ইমানী বিনয়কেও হারাচ্ছেন।
অন্যের ক্ষতি নয়, সুরক্ষা: রাস্তার হক আদায়–
ইসলামে ‘অধিকার’ বা ‘হক’ রক্ষা করাকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আপনার বাইক চালানোর সময় আপনি শুধু নিজের অধিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না; বরং পথচারী, অন্য চালক এবং পরিবেশের অধিকারও রক্ষা করবেন।
আল্লাহর রাসূল (সা.) সাহাবিদের রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। যখন সাহাবীরা বসতে চাইলেন, তিনি বললেন, “তবে রাস্তার হক (অধিকার) আদায় করো। রাস্তার হকের মধ্যে অন্যতম হলো: কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।” (সহীহ বুখারী: ২৪৬৫)
বেপরোয়া গতিতে হুট করে সামনে চলে আসা, বিকট হর্ন বা সাইলেন্সারের শব্দে অন্যকে চমকে দেওয়া বা ভয় দেখানো এগুলো সবই অন্যকে কষ্ট দেওয়া। একজন মুমিন কখনোই তার হাত বা তার বাহনের মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না।
একবার সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রাসূল (সা.) এর সাথে চলতে চলতে দেখলেন, এক বৃদ্ধা মহিলা পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। রাসূল (সা.) দ্রুত চলে গেলেন না, বরং বিনয়ের সাথে পাশে দাঁড়ালেন। তিনি বৃদ্ধাকে তার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সাহায্য করলেন।
এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, রাস্তায় আপনার নিজের জরুরি প্রয়োজন থাকলেও, দুর্বল ও অভাবী মানুষের প্রতি দয়া ও সহমর্মিতা দেখানো একজন মুমিনের প্রধান কর্তব্য। আপনার দ্রুত গতি সেই বৃদ্ধার পথ চলাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারত।
ধৈর্য ও সংযম: আল্লাহর আমানত রক্ষা–
বাইক চালানোর সময় হঠাৎ মাথা গরম করে ফেলা, ঝগড়া করা বা আক্রমণাত্মক হওয়া এগুলো বাইকারদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু একজন মুমিনকে সব পরিস্থিতিতে ধৈর্যশীল ও সংযমী হতে হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)
বেপরোয়াভাবে বাইক চালিয়ে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করা বা রেগে গিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হওয়া এগুলো নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর। আপনার জীবন আল্লাহর আমানত।
আপনি একটি মূল্যবান থালায় গরম দুধ নিয়ে যাচ্ছেন। দুধের থালাটি আপনার কাছে একটি আমানত। আপনি জানেন যদি দ্রুত চলেন বা তাড়াহুড়ো করেন তবে দুধ পড়ে যাবে এবং আপনার কষ্ট হবে। দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো আপনার লক্ষ্য, কিন্তু দুধ না ফেলে পৌঁছানো তার চেয়েও বড় কর্তব্য। তেমনি আপনার জীবন, আপনার বাইক, এবং রাস্তায় থাকা প্রতিটি মানুষ আপনার জন্য আমানত। বাইক চালানোর সময় আপনার মনোযোগ যেন শুধু গতির নেশায় নয়, বরং সংযম ও নিরাপত্তার দিকে থাকে।
পরিশেষে, আপনার বাইকটি আপনার স্বাধীনতার প্রতীক হতে পারে। কিন্তু এটি যেন আপনার বিনয় ও দায়িত্বশীলতার প্রতীকও হয়। গতি নয় আপনার নম্র আচরণই আপনার সত্যিকারের পরিচয়। রাস্তায় যখন আপনি ধীরে চলেন, ট্রাফিক আইন মানেন, হর্ন কম ব্যবহার করেন এবং অন্য চালকদের প্রতি সম্মান দেখান, তখন আপনি কেবল একজন ভালো বাইকার নন। বরং আল্লাহর নির্দেশিত একজন উত্তম মুমিন হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেন।
আসুন আমাদের বাইকের মাধ্যমে সমাজে উগ্রতার নয় বরং শান্তি, শৃঙ্খলা ও বিনয়ের বার্তা ছড়িয়ে দেই।
লেখক: এম. আব্দুল্লাহ
সংগঠক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট