বাংলাদেশ ০১:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ৯ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চোখকে বাঁচান: গ্লুকোমার ভয়াবহতা ও প্রতিকার

গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ, যা অপটিক স্নায়ুর (optic nerve) ক্ষতির কারণে দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে পারে। এটি প্রায়শই চোখের ভেতরের চাপ (intraocular pressure – IOP) অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটে থাকে। এই রোগটিকে “নীরব ঘাতক” বলা হয় কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না, এবং যখন লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হয়, তখন দৃষ্টিশক্তির অনেকখানি ক্ষতি হয়ে যায়, যা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা না হলে গ্লুকোমা অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে।

গ্লুকোমা কী এবং কেন হয়?

আমাদের চোখের অভ্যন্তরে ‘অ্যাকুয়াস হিউমার’ (aqueous humor) নামক একটি তরল পদার্থ তৈরি হয়, যা চোখের পুষ্টি যোগায় এবং চোখকে সতেজ রাখে। এই তরল একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে চোখ থেকে বেরিয়ে যায়। যখন এই তরল নিষ্কাশন ব্যবস্থায় কোনো বাধা সৃষ্টি হয় বা তরল অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হয়, তখন চোখের ভেতরের চাপ বেড়ে যায়। এই বর্ধিত চাপ অপটিক স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে এটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপটিক স্নায়ু আমাদের চোখ থেকে মস্তিষ্কে চিত্র সংকেত বহন করে, তাই এর ক্ষতি হলে দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হয়।

গ্লুকোমার প্রধান কারণ চোখের অতিরিক্ত চাপ হলেও, কিছু ক্ষেত্রে স্বাভাবিক চাপেও গ্লুকোমা হতে পারে, যাকে ‘নরমাল টেনশন গ্লুকোমা’ (Normal Tension Glaucoma) বলা হয়। এর কারণ সম্পূর্ণভাবে জানা না গেলেও, অপটিক স্নায়ুতে রক্ত ​​প্রবাহের ঘাটতি একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরা হয়।

গ্লুকোমার প্রকারভেদ

গ্লুকোমার কয়েকটি প্রধান প্রকার রয়েছে:

  • ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা (Open-Angle Glaucoma): এটি গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। এক্ষেত্রে চোখের ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেল (যেখান দিয়ে তরল বের হয়) খোলা থাকে, কিন্তু তরল নিষ্কাশন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর কোনো প্রাথমিক লক্ষণ থাকে না এবং দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমা (Angle-Closure Glaucoma): এই প্রকার গ্লুকোমা হঠাৎ করে চোখের চাপ মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তরল বের হতে পারে না। এর লক্ষণগুলো হলো তীব্র চোখের ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, আলোর চারপাশে রংধনুর মতো রিং দেখা এবং হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া। এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
  • নরমাল টেনশন গ্লুকোমা (Normal Tension Glaucoma): এই গ্লুকোমায় চোখের চাপ স্বাভাবিক থাকলেও অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি হয়। এর কারণগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, তবে রক্ত ​​প্রবাহের সমস্যা বা অপটিক স্নায়ুর সংবেদনশীলতা এর জন্য দায়ী হতে পারে।
  • সেকেন্ডারি গ্লুকোমা (Secondary Glaucoma): এটি অন্যান্য রোগের (যেমন – ডায়াবেটিস, চোখের আঘাত, প্রদাহ, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) কারণে ঘটে থাকে।
  • কনজেনিটাল গ্লুকোমা (Congenital Glaucoma): এটি জন্মগত গ্লুকোমা, যা শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এটি জন্ম থেকেই বিদ্যমান চোখের ড্রেনেজ সিস্টেমের ত্রুটির কারণে হয়।

গ্লুকোমার ঝুঁকি কাদের বেশি?

কিছু কারণ গ্লুকোমার ঝুঁকি বাড়ায়:

  • বয়স: ৪০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি, এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি আরও বাড়ে।
  • পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কারো গ্লুকোমা থাকলে আপনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • জাতিগত পরিচয়: আফ্রিকান, হিস্পানিক এবং এশিয়ান বংশোদ্ভূতদের মধ্যে গ্লুকোমার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
  • উচ্চ মায়োপিয়া (Short-sightedness): অতিরিক্ত মায়োপিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি।
  • ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের গ্লুকোমা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • উচ্চ রক্তচাপ: অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ গ্লুকোমার কারণ হতে পারে।
  • মাইগ্রেন: মাইগ্রেন রোগীদের মধ্যে গ্লুকোমার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
  • কিছু ঔষধ: কিছু স্টেরয়েড ঔষধের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার চোখের চাপ বাড়াতে পারে।
  • চোখের আঘাত: পূর্বে চোখে কোনো আঘাত লাগলে গ্লুকোমার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

গ্লুকোমার লক্ষণ

যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ থাকে না। দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া শুরু হয় প্রান্তিক দৃষ্টি থেকে এবং ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিকেও প্রভাবিত করে। যখন রোগী বুঝতে পারেন যে তার দৃষ্টিশক্তি কমেছে, তখন অপটিক স্নায়ুর প্রায় ৪০% ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো হঠাৎ এবং তীব্র হয়:

  • চোখে তীব্র ব্যথা
  • মাথাব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • আলোর চারপাশে রংধনুর মতো রিং দেখা
  • হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া বা ঝাপসা দেখা
  • চোখ লাল হয়ে যাওয়া

রোগ নির্ণয়

গ্লুকোমা নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত চোখ পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করতে পারেন:

  • টোনোমেট্রি (Tonometry): চোখের ভেতরের চাপ পরিমাপ করা।
  • অপটিক স্নায়ুর পরীক্ষা (Ophthalmoscopy/OCT): অপটিক স্নায়ুর অবস্থা পরীক্ষা করা। অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি (OCT) অপটিক স্নায়ুর সূক্ষ্ম পরিবর্তনও শনাক্ত করতে পারে।
  • ভিজ্যুয়াল ফিল্ড টেস্ট (Visual Field Test): দৃষ্টিশক্তির পরিসর পরিমাপ করা। এটি গ্লুকোমা দ্বারা সৃষ্ট প্রান্তিক দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি নির্ণয়ে সাহায্য করে।
  • গনিওস্কোপি (Gonioscopy): চোখের ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেলের অবস্থা পরীক্ষা করা।
  • পাকিমেট্রি (Pachymetry): কর্নিয়ার পুরুত্ব পরিমাপ করা, যা চোখের চাপ পরিমাপে সহায়তা করে।

চিকিৎসা

গ্লুকোমার কোনো নিরাময় নেই, তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দৃষ্টিশক্তির আরও ক্ষতি রোধ করতে পারে। চিকিৎসার লক্ষ্য হলো চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং অপটিক স্নায়ুর আরও ক্ষতি রোধ করা।

  • আই ড্রপস (Eye Drops): এটি গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা। বিভিন্ন ধরণের ড্রপ চোখের তরল উৎপাদন কমাতে বা তরল নিষ্কাশন বাড়াতে সাহায্য করে।
  • লেজার চিকিৎসা (Laser Treatment): কিছু ক্ষেত্রে লেজার চিকিৎসা কার্যকর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমার জন্য লেজার ইরিডোটমি (Laser Iridotomy) করা হয়, যেখানে চোখের আইরিসে একটি ছোট ছিদ্র করা হয় যাতে তরল নিষ্কাশন সহজ হয়। ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার জন্য লেজার ট্রাবেকুলোপ্লাস্টি (Laser Trabeculoplasty) করা হয়, যা ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেলের কার্যকারিতা উন্নত করে।
  • সার্জারি (Surgery): যখন আই ড্রপস বা লেজার চিকিৎসায় কাজ হয় না, তখন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। ট্রাবেকুলেক্টমি (Trabeculectomy) নামক একটি অস্ত্রোপচারে চোখে একটি নতুন পথ তৈরি করা হয় যাতে তরল চোখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়াও গ্লুকোমা ড্রেনেজ ডিভাইস ইমপ্ল্যান্ট (Glaucoma Drainage Device Implant) বসানোর মাধ্যমেও চোখের চাপ কমানো যেতে পারে।

প্রতিরোধ ও সতর্কতা

গ্লুকোমা প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করা সম্ভব।

  • নিয়মিত চোখ পরীক্ষা: ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি এক থেকে দুই বছর অন্তর নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে যদি আপনার গ্লুকোমার পারিবারিক ইতিহাস থাকে।
  • ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা: গ্লুকোমার ঝুঁকির কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • সুস্থ জীবনযাপন: সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ধূমপান পরিহার করে সুস্থ জীবনযাপন চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।

গ্লুকোমা একটি গুরুতর চোখের রোগ, যা অসাবধানতা বা অবহেলার কারণে স্থায়ী অন্ধত্ব ঘটাতে পারে। যেহেতু এর প্রাথমিক কোনো লক্ষণ থাকে না, তাই নিয়মিত চোখের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখবেন, আপনার দৃষ্টিশক্তি অমূল্য এবং এর সুরক্ষায় কোনো আপস নয়। সময়মতো সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই গ্লুকোমার মতো নীরব ঘাতক থেকে আপনার দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করা সম্ভব।

ট্যাগ :

চোখকে বাঁচান: গ্লুকোমার ভয়াবহতা ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ১২:৪৩:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫

গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ, যা অপটিক স্নায়ুর (optic nerve) ক্ষতির কারণে দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে পারে। এটি প্রায়শই চোখের ভেতরের চাপ (intraocular pressure – IOP) অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটে থাকে। এই রোগটিকে “নীরব ঘাতক” বলা হয় কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না, এবং যখন লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হয়, তখন দৃষ্টিশক্তির অনেকখানি ক্ষতি হয়ে যায়, যা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা না হলে গ্লুকোমা অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে।

গ্লুকোমা কী এবং কেন হয়?

আমাদের চোখের অভ্যন্তরে ‘অ্যাকুয়াস হিউমার’ (aqueous humor) নামক একটি তরল পদার্থ তৈরি হয়, যা চোখের পুষ্টি যোগায় এবং চোখকে সতেজ রাখে। এই তরল একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে চোখ থেকে বেরিয়ে যায়। যখন এই তরল নিষ্কাশন ব্যবস্থায় কোনো বাধা সৃষ্টি হয় বা তরল অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হয়, তখন চোখের ভেতরের চাপ বেড়ে যায়। এই বর্ধিত চাপ অপটিক স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে এটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপটিক স্নায়ু আমাদের চোখ থেকে মস্তিষ্কে চিত্র সংকেত বহন করে, তাই এর ক্ষতি হলে দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হয়।

গ্লুকোমার প্রধান কারণ চোখের অতিরিক্ত চাপ হলেও, কিছু ক্ষেত্রে স্বাভাবিক চাপেও গ্লুকোমা হতে পারে, যাকে ‘নরমাল টেনশন গ্লুকোমা’ (Normal Tension Glaucoma) বলা হয়। এর কারণ সম্পূর্ণভাবে জানা না গেলেও, অপটিক স্নায়ুতে রক্ত ​​প্রবাহের ঘাটতি একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরা হয়।

গ্লুকোমার প্রকারভেদ

গ্লুকোমার কয়েকটি প্রধান প্রকার রয়েছে:

  • ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা (Open-Angle Glaucoma): এটি গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। এক্ষেত্রে চোখের ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেল (যেখান দিয়ে তরল বের হয়) খোলা থাকে, কিন্তু তরল নিষ্কাশন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর কোনো প্রাথমিক লক্ষণ থাকে না এবং দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমা (Angle-Closure Glaucoma): এই প্রকার গ্লুকোমা হঠাৎ করে চোখের চাপ মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তরল বের হতে পারে না। এর লক্ষণগুলো হলো তীব্র চোখের ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, আলোর চারপাশে রংধনুর মতো রিং দেখা এবং হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া। এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
  • নরমাল টেনশন গ্লুকোমা (Normal Tension Glaucoma): এই গ্লুকোমায় চোখের চাপ স্বাভাবিক থাকলেও অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি হয়। এর কারণগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, তবে রক্ত ​​প্রবাহের সমস্যা বা অপটিক স্নায়ুর সংবেদনশীলতা এর জন্য দায়ী হতে পারে।
  • সেকেন্ডারি গ্লুকোমা (Secondary Glaucoma): এটি অন্যান্য রোগের (যেমন – ডায়াবেটিস, চোখের আঘাত, প্রদাহ, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) কারণে ঘটে থাকে।
  • কনজেনিটাল গ্লুকোমা (Congenital Glaucoma): এটি জন্মগত গ্লুকোমা, যা শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এটি জন্ম থেকেই বিদ্যমান চোখের ড্রেনেজ সিস্টেমের ত্রুটির কারণে হয়।

গ্লুকোমার ঝুঁকি কাদের বেশি?

কিছু কারণ গ্লুকোমার ঝুঁকি বাড়ায়:

  • বয়স: ৪০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি, এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি আরও বাড়ে।
  • পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কারো গ্লুকোমা থাকলে আপনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • জাতিগত পরিচয়: আফ্রিকান, হিস্পানিক এবং এশিয়ান বংশোদ্ভূতদের মধ্যে গ্লুকোমার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
  • উচ্চ মায়োপিয়া (Short-sightedness): অতিরিক্ত মায়োপিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি।
  • ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের গ্লুকোমা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • উচ্চ রক্তচাপ: অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ গ্লুকোমার কারণ হতে পারে।
  • মাইগ্রেন: মাইগ্রেন রোগীদের মধ্যে গ্লুকোমার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
  • কিছু ঔষধ: কিছু স্টেরয়েড ঔষধের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার চোখের চাপ বাড়াতে পারে।
  • চোখের আঘাত: পূর্বে চোখে কোনো আঘাত লাগলে গ্লুকোমার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

গ্লুকোমার লক্ষণ

যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ থাকে না। দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া শুরু হয় প্রান্তিক দৃষ্টি থেকে এবং ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিকেও প্রভাবিত করে। যখন রোগী বুঝতে পারেন যে তার দৃষ্টিশক্তি কমেছে, তখন অপটিক স্নায়ুর প্রায় ৪০% ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো হঠাৎ এবং তীব্র হয়:

  • চোখে তীব্র ব্যথা
  • মাথাব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • আলোর চারপাশে রংধনুর মতো রিং দেখা
  • হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া বা ঝাপসা দেখা
  • চোখ লাল হয়ে যাওয়া

রোগ নির্ণয়

গ্লুকোমা নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত চোখ পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করতে পারেন:

  • টোনোমেট্রি (Tonometry): চোখের ভেতরের চাপ পরিমাপ করা।
  • অপটিক স্নায়ুর পরীক্ষা (Ophthalmoscopy/OCT): অপটিক স্নায়ুর অবস্থা পরীক্ষা করা। অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি (OCT) অপটিক স্নায়ুর সূক্ষ্ম পরিবর্তনও শনাক্ত করতে পারে।
  • ভিজ্যুয়াল ফিল্ড টেস্ট (Visual Field Test): দৃষ্টিশক্তির পরিসর পরিমাপ করা। এটি গ্লুকোমা দ্বারা সৃষ্ট প্রান্তিক দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি নির্ণয়ে সাহায্য করে।
  • গনিওস্কোপি (Gonioscopy): চোখের ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেলের অবস্থা পরীক্ষা করা।
  • পাকিমেট্রি (Pachymetry): কর্নিয়ার পুরুত্ব পরিমাপ করা, যা চোখের চাপ পরিমাপে সহায়তা করে।

চিকিৎসা

গ্লুকোমার কোনো নিরাময় নেই, তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দৃষ্টিশক্তির আরও ক্ষতি রোধ করতে পারে। চিকিৎসার লক্ষ্য হলো চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং অপটিক স্নায়ুর আরও ক্ষতি রোধ করা।

  • আই ড্রপস (Eye Drops): এটি গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা। বিভিন্ন ধরণের ড্রপ চোখের তরল উৎপাদন কমাতে বা তরল নিষ্কাশন বাড়াতে সাহায্য করে।
  • লেজার চিকিৎসা (Laser Treatment): কিছু ক্ষেত্রে লেজার চিকিৎসা কার্যকর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমার জন্য লেজার ইরিডোটমি (Laser Iridotomy) করা হয়, যেখানে চোখের আইরিসে একটি ছোট ছিদ্র করা হয় যাতে তরল নিষ্কাশন সহজ হয়। ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার জন্য লেজার ট্রাবেকুলোপ্লাস্টি (Laser Trabeculoplasty) করা হয়, যা ড্রেনেজ অ্যাঙ্গেলের কার্যকারিতা উন্নত করে।
  • সার্জারি (Surgery): যখন আই ড্রপস বা লেজার চিকিৎসায় কাজ হয় না, তখন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। ট্রাবেকুলেক্টমি (Trabeculectomy) নামক একটি অস্ত্রোপচারে চোখে একটি নতুন পথ তৈরি করা হয় যাতে তরল চোখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়াও গ্লুকোমা ড্রেনেজ ডিভাইস ইমপ্ল্যান্ট (Glaucoma Drainage Device Implant) বসানোর মাধ্যমেও চোখের চাপ কমানো যেতে পারে।

প্রতিরোধ ও সতর্কতা

গ্লুকোমা প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করা সম্ভব।

  • নিয়মিত চোখ পরীক্ষা: ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি এক থেকে দুই বছর অন্তর নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে যদি আপনার গ্লুকোমার পারিবারিক ইতিহাস থাকে।
  • ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা: গ্লুকোমার ঝুঁকির কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • সুস্থ জীবনযাপন: সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ধূমপান পরিহার করে সুস্থ জীবনযাপন চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।

গ্লুকোমা একটি গুরুতর চোখের রোগ, যা অসাবধানতা বা অবহেলার কারণে স্থায়ী অন্ধত্ব ঘটাতে পারে। যেহেতু এর প্রাথমিক কোনো লক্ষণ থাকে না, তাই নিয়মিত চোখের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখবেন, আপনার দৃষ্টিশক্তি অমূল্য এবং এর সুরক্ষায় কোনো আপস নয়। সময়মতো সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই গ্লুকোমার মতো নীরব ঘাতক থেকে আপনার দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করা সম্ভব।