বাংলাদেশ ০১:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ৯ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আবারো নৃশংসতা: রাজনীতির করুণ অবক্ষয়

যে রাজনীতি একসময় মানুষের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নের ভিত্তি ছিল, সেই রাজনীতি আজ পরিণত হয়েছে ক্ষমতা দখলের এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায় নৈতিকতা, মানবিকতা এবং আদর্শের চরম অবক্ষয় ঘটেছে, যার নির্মম প্রতিচ্ছবি বারবার দেখতে হয় আমাদের। যখন একজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয় পাথরের আঘাতে, আর সেই নিথর দেহের ওপর চলে উল্লাস, তখন তা কেবল একটি হত্যাকাণ্ড থাকে না। এ দৃশ্য আমাদের সভ্যতার স্তম্ভে ফাটল ধরায়। এটি কেবল এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি মানবতাবোধের মৃত্যু; বিবেক আর শুভবুদ্ধির পরাজয়। এই বর্বরতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক বিষাক্ত প্রেতাত্মা, যা বারবার আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ২০০৬ সালের সেই ভয়ংকর ২৮শে অক্টোবরের নির্মমতা যেন আবারো ফিরে এলো এক নতুন রূপে। ২৪’র গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতিকে দেখতে হলো ফ্যাসিবাদী জাহেলিয়াতের আরেক নৃশংস প্রতিচ্ছবি।

মানুষ নয়, নির্মূল করার যোগ্য বস্তু– রাজনীতির এই করুণ অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় যখন প্রতিপক্ষকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠা’র তাণ্ডবে যা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার চেয়েও বেশি কিছু—তা ছিল চরম অবমাননা এবং এক ভয়ংকর বার্তা। মানুষের মৃতদেহের ওপর উল্লাস করে সেদিন প্রমাণ করা হয়েছিল, শত্রুকে আর মানুষ নয়, বরং নির্মূল করার যোগ্য বস্তু হিসেবে দেখা হয়। সাম্প্রতিক এই নৃশংসতা, যেখানে একজন মানুষকে পাথর মেরে হত্যা করার পর তার লাশের ওপর চলে পাশবিক উল্লাস, সেই একই বর্বরতার প্রতিধ্বনি। এটি কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, যা সমগ্র জাতিকে আতঙ্কিত ও হতাশ করে তোলে। এই পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, এই ধরনের নৃশংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।

বিচারহীনতার বিষাক্ত শৃঙ্খল– নৃশংসতার এই বারবার ফিরে আসার মূল কারণ হলো দায়মুক্তির সংস্কৃতি। যদি অতীতে এমন জঘন্য ঘটনার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হতো, তাহলে হয়তো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটত না। কিন্তু যখন অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, তখন তা নতুন অপরাধের জন্য একটি নীরব অনুমোদন হিসেবে কাজ করে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের মনে এই বিশ্বাস তৈরি করে যে, তারা যা-ই করুক না কেন, তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। তাই, এক প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীরা যে বর্বরতা দেখে বড় হয়, পরবর্তী প্রজন্ম সেই বর্বরতাকেই তাদের স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গ্রহণ করে। এটি একটি বিষাক্ত শৃঙ্খল, যা আমাদের রাজনীতিকে নৈতিকতাশূন্য করে তুলছে এবং মানবিক মূল্যবোধের কবর রচনা করছে।

রাজনৈতিক আদর্শের অবক্ষয়– এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, আমাদের রাজনীতিতে আদর্শ, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। যেখানে রাজনীতি মানুষের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নে কাজ করার কথা। সেখানে তা পরিণত হয়েছে ক্ষমতা দখলের এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য যেকোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা বৈধ মনে করা হয়, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো নৃশংসতা ও বর্বরতা। একই দৃশ্যের বারবার ফিরে আসা একটি জাতির জন্য এক গভীর লজ্জার বিষয়। কারণ এটি প্রমাণ করে যে, আমরা এখনো সেই আদিম, হিংস্র রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে বের হতে পারিনি।

জনগণের মনে গভীর ক্ষত– যখন মানুষ বারবার একই ধরনের হিংস্রতা দেখে, তখন তাদের মনে ভয়ের পাশাপাশি হতাশা ও অনাস্থা জন্ম নেয়। তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারায় এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, গণতন্ত্র ও মানবিকতা কেবল কথার কথা। এই পুনরাবৃত্তি সমাজকে সংবেদনশীলতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা তৈরি করে। মানুষ হয়তো প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়, অথবা তারা এতটাই ভীত হয়ে পড়ে যে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।

এই মর্মন্তুদ পুনরাবৃত্তি তাই কেবল দুটি পৃথক ঘটনার মিল নয়, এটি এক গভীর রাজনৈতিক রোগের উপসর্গ। এই রোগ নিরাময় করতে হলে শুধু একটি ঘটনার নিন্দা নয়, বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। যেখানে মানব জীবনকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।

লেখক: সংগঠক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

আবারো নৃশংসতা: রাজনীতির করুণ অবক্ষয়

প্রকাশিত: ০৯:২২:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

যে রাজনীতি একসময় মানুষের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নের ভিত্তি ছিল, সেই রাজনীতি আজ পরিণত হয়েছে ক্ষমতা দখলের এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায় নৈতিকতা, মানবিকতা এবং আদর্শের চরম অবক্ষয় ঘটেছে, যার নির্মম প্রতিচ্ছবি বারবার দেখতে হয় আমাদের। যখন একজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয় পাথরের আঘাতে, আর সেই নিথর দেহের ওপর চলে উল্লাস, তখন তা কেবল একটি হত্যাকাণ্ড থাকে না। এ দৃশ্য আমাদের সভ্যতার স্তম্ভে ফাটল ধরায়। এটি কেবল এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি মানবতাবোধের মৃত্যু; বিবেক আর শুভবুদ্ধির পরাজয়। এই বর্বরতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক বিষাক্ত প্রেতাত্মা, যা বারবার আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ২০০৬ সালের সেই ভয়ংকর ২৮শে অক্টোবরের নির্মমতা যেন আবারো ফিরে এলো এক নতুন রূপে। ২৪’র গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতিকে দেখতে হলো ফ্যাসিবাদী জাহেলিয়াতের আরেক নৃশংস প্রতিচ্ছবি।

মানুষ নয়, নির্মূল করার যোগ্য বস্তু– রাজনীতির এই করুণ অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় যখন প্রতিপক্ষকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠা’র তাণ্ডবে যা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার চেয়েও বেশি কিছু—তা ছিল চরম অবমাননা এবং এক ভয়ংকর বার্তা। মানুষের মৃতদেহের ওপর উল্লাস করে সেদিন প্রমাণ করা হয়েছিল, শত্রুকে আর মানুষ নয়, বরং নির্মূল করার যোগ্য বস্তু হিসেবে দেখা হয়। সাম্প্রতিক এই নৃশংসতা, যেখানে একজন মানুষকে পাথর মেরে হত্যা করার পর তার লাশের ওপর চলে পাশবিক উল্লাস, সেই একই বর্বরতার প্রতিধ্বনি। এটি কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, যা সমগ্র জাতিকে আতঙ্কিত ও হতাশ করে তোলে। এই পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, এই ধরনের নৃশংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।

বিচারহীনতার বিষাক্ত শৃঙ্খল– নৃশংসতার এই বারবার ফিরে আসার মূল কারণ হলো দায়মুক্তির সংস্কৃতি। যদি অতীতে এমন জঘন্য ঘটনার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হতো, তাহলে হয়তো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটত না। কিন্তু যখন অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, তখন তা নতুন অপরাধের জন্য একটি নীরব অনুমোদন হিসেবে কাজ করে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের মনে এই বিশ্বাস তৈরি করে যে, তারা যা-ই করুক না কেন, তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। তাই, এক প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীরা যে বর্বরতা দেখে বড় হয়, পরবর্তী প্রজন্ম সেই বর্বরতাকেই তাদের স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গ্রহণ করে। এটি একটি বিষাক্ত শৃঙ্খল, যা আমাদের রাজনীতিকে নৈতিকতাশূন্য করে তুলছে এবং মানবিক মূল্যবোধের কবর রচনা করছে।

রাজনৈতিক আদর্শের অবক্ষয়– এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, আমাদের রাজনীতিতে আদর্শ, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। যেখানে রাজনীতি মানুষের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নে কাজ করার কথা। সেখানে তা পরিণত হয়েছে ক্ষমতা দখলের এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য যেকোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা বৈধ মনে করা হয়, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো নৃশংসতা ও বর্বরতা। একই দৃশ্যের বারবার ফিরে আসা একটি জাতির জন্য এক গভীর লজ্জার বিষয়। কারণ এটি প্রমাণ করে যে, আমরা এখনো সেই আদিম, হিংস্র রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে বের হতে পারিনি।

জনগণের মনে গভীর ক্ষত– যখন মানুষ বারবার একই ধরনের হিংস্রতা দেখে, তখন তাদের মনে ভয়ের পাশাপাশি হতাশা ও অনাস্থা জন্ম নেয়। তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারায় এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, গণতন্ত্র ও মানবিকতা কেবল কথার কথা। এই পুনরাবৃত্তি সমাজকে সংবেদনশীলতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা তৈরি করে। মানুষ হয়তো প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়, অথবা তারা এতটাই ভীত হয়ে পড়ে যে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।

এই মর্মন্তুদ পুনরাবৃত্তি তাই কেবল দুটি পৃথক ঘটনার মিল নয়, এটি এক গভীর রাজনৈতিক রোগের উপসর্গ। এই রোগ নিরাময় করতে হলে শুধু একটি ঘটনার নিন্দা নয়, বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। যেখানে মানব জীবনকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।

লেখক: সংগঠক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট